বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ০৫:৩৬ অপরাহ্ন

সচেতনতা এবং আইনের কঠোর বাস্তবায়নে বাল্যবিবাহ বন্ধ হতে বাধ্য

Reporter Name
  • Update Time : শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩
  • ১৬৬ Time View

নৌকা ঘাটে ভিরাতেই ভেসে আসে কাঁন্নার শব্দ। কে যেন কাঁদছে। নৌকার পাটাতনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকালাম বেনি করা চুল, লালা সবুজ ফিতায় বাঁধা, দূর থেকে বেনির শেষ প্রান্তটা পতাকার মতো মনে হয়। ঠোঁটে লিপিস্টিক নেই। নাকের উপর মস্ত বড় নাক ফুলটাকে মনে হয় আগ্নেয়গিরির জ্বালা মুখ। মেয়েটির কাজল ধোঁয়া চোখের পানি কপোল গড়িয়ে ঝরে পড়ছে, পিঠে ঝোলানো স্কুল ব্যাগটি শক্ত করে ধরে নিয়ে মেয়েটি চিৎকার করে বলে ওঠে, আমি যাবো না।

প্রশ্ন করি, কোথায়? কে যেন পাশ থেকে উত্তর দেয়, “শ্বশুরবাড়িতে।” ঠিক এভাবেই বাসন্তীদের জীবনের বসন্ত গুলো মুছে যায় মেহেদির লাল রং এর মাঝে। আমি এমন এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমার এ লেখাটা লিখছি, যখন দেশের ৬৬% নারী সবগুলো দাঁতের মালিক হওয়র আগেই স্বামীর মালিক হচ্ছে। আমি এমন এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমার এ লেখাটা লিখছি যখন দেশে বাল্য বিবাহ নামে নারীদেরকে ঠেলে দেওয় হচ্ছে শারীরিক নির্যাতনের দিকে। যা বন্ধের প্রয়জন সচেতনতার বলয় গড়ে তোলা।

আমি আইনের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করছি না। শুধু আইন দ্বারা যে কোনো সমস্যা সাময়িকের জন্য কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও চিরদিনের মতো নির্মূল করা সম্ভব নয়। তা কেন সম্ভব নয়? আমি আমার লেখায় সেটা তুলে ধরছি।সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত আইন ছিল হাম্বুরাবির আইন বা The Code of Humburabi’।

১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট হাম্বুরি আইন প্রণয়ন করেন। ২৮২ ধারা সম্বলিত এই আইন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত এটাই বিশ্বাস করা হয় যে এটা পৃথিবীর কঠিনতম আইন। হাম্বুরি আইন ছিল পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠোরা আইন। অন্যদিকে আমরা যদি বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই, বাংলাদেশের জন্য মোট আইনের ধারা ৫১১টি কিন্তু হতাশার ব্যাপার হলো টিআইবির হিসাব মতে বাংলাদেশের ১০% আইনেরও যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না (সূত্র দৈনিক সমকাল ১২/০৬/২০১৪ )।

এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমি যদি মেনেও নিই আইন কঠোর হলে বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে তাহলে আপনারা কি সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই নিশ্চয়তা টুকু দিতে পারবেন সেই কঠোর আইনের বাস্তবায়ন সম্ভব হবে? আর আপনারা যদি এই নিশ্চয়তা টুকু দিতে ব্যর্থ হন তাহলে আপনাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে বাল্য বিবাহ বন্ধে শুধু আইন যথেষ্ট নয়, সচেতনতার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। আমার চাচাকে বহুবার দেখেছি পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে। কখনো কখনো দেখেছি পুলিশের কারো কাছ থেকে আগুন চেয়ে নিতে, সিগারেট ধরাবার জন্য কিন্তু এটা আমি কখনোই দেখিনি তিনি তাঁর সন্তানের কাছে বসে চাচা ধূমপান করছেন।

আমি যদি ঘটনাটিকে দুটি দিক থেকে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই একদিকে একশো টাকার জরিমানার ভয়ে চাচা ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে পারছেন না অন্যদিকে তার সন্তানের ক্ষতির কথাটি চিন্তা করেই তিনি ধূমপান করা থেকে বিরত থাকছেন। আমি ঠিক এই জায়গাটিতেই কলম ধরছি, যখন বিবেকের আদালতে দাঁড়িয়ে প্রতিটি মানুষ ভালোমন্দের বোধটি অর্জন করবে ঠিক তখনই তাদের মধ্যে তৈরি হবে সচেতনতা এবং ঘুচে যাবে বাল্য বিবাহের অভিশাপ। আমার পাশের বাসার এক বোন শেফালী। গত মাসের ১০ তারিখে জরায়ু ক্যান্সার মারা যায়। আরেক আপু পড়াশুনায় খুব ভালো ছিল। যেদিন তাকে প্রথম দেখতে আসে, সেদিন তার সে কি কাঁন্না? আপুকে ধমক দিয়ে তার দাদিমা সেদিন বলেছিল, “এই গেদি,ঘরে গাছ থাকলে মানুষ তো ঢিল দিবে”। সেদিন শুধু ঢিল পড়েনি এক দেখাতে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যায়। আপুর সে সময় গুলো চুপচাপে কাটতো।

জানালার বাইরে শিউলি তলায় পড়ে থাকা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো অপলক। আমাকে কাছে ডেকে বলতো,” ঝরে যাওয়া ফুল আর তার মধ্যে নাকি কোন পার্থক্য নেই।” বিয়ের আগের দিন রাতে আপু তার বাবার পা জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁন্না কেঁদেছে, চিৎকার করে বলেছিলো, “আব্বা গো এই বিয়ে ভাইঙ্গা দেন। বিয়ে দিলে আমি মইরা যাবো। কথা রেখেছে সে আপু, চলে গেছে অনেক অনেক দূরে না ফেরার দেশে। আইন তো তখনও ছিল, তারপরও কেন সেই আইনে এই বোনের নিরাপত্তা টুকু দিতে পারেনি? অথচ আপুর বাবা মা এবং আপুর পরিবার যদি সচেতন হতেন তাহলে শেফালীরা কোনদিন ঝড়ে পারতো না। তাই আমি বিশ্বাস করি সচেতনতাকে বাদ দিয়ে কেবল আইন দ্বারা বাল্যবিবাহ বন্ধ করা কোনভাবেই সম্ভব না। আইন কঠোর করা হয়েছে, তারপরও বন্ধ হচ্ছে না বাল্যবিবাহ।

লক্ষ্য করলে দেখি , even women এর হিসাব মতে ২০১৫ সালের প্রথম দুই মাসে সারা দেশে বাল্য বিবাহের ঘটনা ঘটেছে ৩০৩টি যার মধ্যে মামলা হয়েছে সাতটিতে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে মাত্র ৫ জনকে। এই যদি হয় কঠোর আইনের করুন দশা তাহলে আমরা সচেতনতাকে বাদ দিয়ে কিভাবে শুধু আইনের উপর আস্থা রাখবো? গল্পগুলো সত্যি হলেও পারতো যখন সভ্যতার পাঁচিলে লেখা হতো সাম্যের গান গাই, আমার চোখে নারী পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নাই। গল্পগুলো সত্যি হতে শুরু করেছে। সচেতনা বেড়েছে, বেড়েছে আইনের কঠোর প্রয়োগ। লেখা শেষ করবো তবে শেষ করার আগে পাঠকের কাছে কিছু প্রশ্ন রেখে যাবো। আইন দিয়ে যদি সকল সমস্যার সমাধান করা যেত তবে কেন আমরা দুর্নীতির অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারছি না? কেন আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা? কেন পেট্রোলবোমার নৃশংসতায় ঝলসে যাচ্ছে বাংলা মায়ের মুখ? কেন মানচিত্রে পেট হতে ধনিত হয় আর্তের হাহাকার? কেন কেন? লেখার ধরণঃ-বিশ্লেষণধর্মী

লেখক: মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কলাম লেখক

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2019 bhabisyatbangladesh
Developed by: A TO Z IT HOST
Tuhin