বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪০ অপরাহ্ন

জি কে শামীম এত কাজ পেলেন কীভাবে

Reporter Name
  • Update Time : রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
  • ১২৪৫ Time View

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবন নির্মাণের কাজে নজিরবিহীন দুর্নীতি ‘বালিশকাণ্ড’ ঘটনার পর যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে আরও সরকারের তিন হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ করছে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের সব ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রক ছিলেন র‌্যাবের হাতে আটক জি কে শামীম। আটক হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তিনি স্বীকারও করেছেন, গণপূর্তের শীর্ষ দুই কর্মকর্তাকে তিনি বিভিন্ন সময়ে ১৫০০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। এর বাইরেও বহু প্রকৌশলীকে ঘুষ দিতে হয়েছে। প্রতিটি কাজ পেতেই তাকে ঘুষ দিতে হয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে প্রধান প্রকৌশলী পর্যন্ত।অবশ্য এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম সমকালের কাছে দাবি করেন, শামীম একজন খারাপ লোক। সে তো খারাপ কথাই বলবে। তবে তিনি এসব ঘুষ-বাণিজ্যের সঙ্গে কোনো সময় জড়িত ছিলেন না। তার চাকরিজীবনে কোনো কালো দাগ নেই। তার সময়ে সব কাজই নিয়মকানুন অনুসরণ করে করা হয়েছে।এ প্রসঙ্গে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন সমকালকে বলেন, সব কাজই এখন ই-টেন্ডারের মাধ্যমে হয়। যিনি সর্বনিম্ন দরদাতা হন, তাকেই কাজ দেওয়া হয়। পছন্দমতো কাউকে কাজ দেওয়ার সুযোগ নেই। সংশ্নিষ্টরা জানান, বর্তমানে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান যে কাজগুলো করছে, সেগুলোর টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের আমলে ও বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেনের সময়ে। এর আগে হাফিজুর রহমান মুন্সি ও কবির আহমেদ ভূঁইয়া প্রধান প্রকৌশলী থাকার সময়েও জি কে শামীম কিছু কাজ পেয়েছেন।

ঠিকাদাররা জানান, ই-টেন্ডার পদ্ধতিতে টেন্ডার হলেও যে ঠিকাদারই কাজ পাক না কেন, সংশ্নিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি, এমনকি প্রধান প্রকৌশলীকেও কমিশন দিতে হয়। গণপূর্তে এটা একেবারেই বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশ আগে থেকেই। তবে যে ঠিকাদার বেশি কমিশন দেন ও লেনদেন ভালো, সেই ঠিকাদারের প্রতি প্রকৌশলীদের বেশি দুর্বলতা থাকে।কারা কাজ দিয়েছিলেন জি কে শামীমকে: জানা গেছে, জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ১৫০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ করছে। এটার বরাদ্দ-সংক্রান্ত কাজ হয়েছে শেরেবাংলা নগর-১ ও গণপূর্ত সার্কেল-৩ থেকে। ১৫০ কোটি টাকার নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কাজও একই জায়গা থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ১৫০ কোটি টাকার পঙ্গু হাসপাতালের নতুন ভবন নির্মাণকাজও বরাদ্দ হয়েছে একই জায়গা থেকে। এসব কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুল হক, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাই। তখন প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন রফিকুল ইসলাম। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন। তাদের মধ্যে রোকন উদ্দিন বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায়। আব্দুল হাই ও রফিকুল ইসলাম অবসরে। নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুল হক সমকালকে বলেন, ওই কাজের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম টেন্ডার করেছিলেন। ওয়ার্ক অর্ডারও তিনিই দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে আমিনুল ইসলাম অবসরে গেছেন।

৩০০ কোটি টাকার পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের কাজের টেন্ডার করা হয়েছে সিটি ডিভিশন নগর বিভাগ সার্কেল-১ থেকে। এ কাজের দায়িত্ব ছিল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল কাদের ও নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত হোসেনের। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল কাদের সমকালকে বলেন, ওই টেন্ডার কে করেছিল, তার মনে নেই। পরে অবশ্য বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত হোসেন টেন্ডার করেছিলেন। এ ব্যাপারে শওকত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সচিবালয়ের বিল্ডিং ও ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সচিবালয়ের কেবিনেট ভবনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল হাই ও নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন। অবশ্য আফছার উদ্দিন বলেন, বর্তমানে যে বিল্ডিংটার কাজ চলছে, সেটার টেন্ডার তিনি করেছিলেন। আরেকটির সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।১৫০ কোটি টাকায় মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে শামীমের প্রতিষ্ঠান। এ কাজের টেন্ডারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল মোমিন চৌধুরী ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোর্শেদ। এর মধ্যে আব্দুল মোমিন চৌধুরী অবসরে গেছেন। এ প্রসঙ্গে মো. মোর্শেদ সমকালকে বলেন, সেটা তো বেশ আগের কথা। কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনও করেছেন। তবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই টেন্ডার হয়েছিল। তখন টেন্ডার করেছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী ইলিয়াস আহমেদ। ইলিয়াস আহমদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।এ ছাড়া ৫০০ কোটি টাকার এনবিআর ভবনের কাজ করা হয়েছে সার্কেল-৩ ও বিভাগ-৩ থেকে। এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন ও নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা। রোকন উদ্দিন অস্ট্রেলিয়ায়। স্বপন চাকমা সমকালকে বলেন, টেন্ডারটা করেছিলেন রোকন স্যার। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে তার যে দায়িত্ব, তিনি সেটা পালন করেছেন মাত্র। তবে ওই টেন্ডারটা ইজিপিতে হয়নি। ম্যানুয়ালি হয়েছিল বলে জানান তিনি।

এভাবে ১৩ কোটি টাকায় পোড়াবাড়িতে র‌্যাব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৫০ কোটি টাকায় এনজিও ভবন, ১২ কোটি টাকায় পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ৩০ কোটি টাকায় বিজ্ঞান জাদুঘর, ১০ কোটি টাকায় বাসাবো বৌদ্ধমন্দির, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, ল্যাবরেটরি মেডিসিন ভবনসহ কিছু প্রকল্পের কাজ করছে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান।র‌্যাব হেডকোয়ার্টার নিয়ে কেলেঙ্কারি: র‌্যাব হেডকোয়ার্টার নির্মাণের টেন্ডার হওয়ার কথা ছিল গণপূর্ত সার্কেল ঢাকা-৩ থেকে। কারণ, ওই এলাকাটা সার্কেল-৩-এর মধ্যে। কিন্তু আকস্মিকভাবে ওই কাজের টেন্ডার করা হয় হেডকোয়ার্টার থেকে। পিঅ্যান্ডএসপি (প্রজেক্ট অ্যান্ড স্পেশাল প্রজেক্ট) থেকে টেন্ডারটি করেন পিঅ্যান্ডএসপির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও বর্তমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল আলম। সদস্য সচিব ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (উন্নয়ন) এস এম জুলকারনাইন। ঠিক একইভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাজ সার্কেল-১-এর অধীনে ছিল। সেটারও টেন্ডার করা হয়েছে হেডকোয়ার্টার থেকে। ওই টেন্ডারের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন ড. মঈনুল। অথচ সম্প্রতি র‌্যাব হেডকোয়ার্টারের টেন্ডারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওএসডি করা হয়েছে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে-কে। এ প্রসঙ্গে ড. মঈনুল কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এস এম জুলকারনাইনের মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। উৎপল কুমার দে বলেন, ওই টেন্ডারের ৯৯ শতাংশ কাজের ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়ার দুই মাস পর তিনি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পান। তাহলে তিনি কীভাবে এটার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সে প্রশ্ন রাখেন তিনি।

তারাই প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার প্রতিযোগিতায়: জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরে প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেনের মেয়াদ শেষ হবে। এ জন্য কয়েকজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জোর তদবির শুরু করেছেন। এ ছাড়া শাহাদত হোসেনও চেষ্টা করছেন তার মেয়াদ বাড়ানোর। তবে চট্টগ্রাম ও ঢাকার পরিত্যক্ত বাড়ির ভবন নির্মাণের টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান থাকার সময় শাহাদত হোসেনের বিরুদ্ধে কমিশন নেওয়ার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া রফিকুল ইসলাম প্রধান প্রকৌশলী থাকার সময় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সংস্থাপন) হিসেবে পদাধিকারবলে শাহাদত হোসেন টেন্ডার ইভল্যুয়েশন কমিটির সভাপতি ছিলেন। ওই সময়ও তার বিরুদ্ধে কমিশন-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া নোয়াখালীতে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে অর্থ আত্মসাতের দায়ে শাহাদত হোসেনকে বরখাস্তও করা হয়েছিল।এর পরেই আছেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন, আশরাফুল আলম, ড. মঈনুল ইসলাম ও উৎপল কুমার দে। সূত্র জানায়, এর মধ্যে উৎপল কুমার দে দৌড়ে এগিয়ে থাকার কারণে তাকে ফাঁসাতেই মিথ্যা অজুহাতে ওএসডি করা হয়েছে। কারণ, প্রধান প্রকৌশলীর দৌড়ে অন্য যারা আছেন, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে সমালোচনা অনেক বেশি। যেমন- ড. মঈনুল ইসলাম চাকরিজীবনের শুরুতে মাঠ পর্যায়ে চাকরি করতে চাননি। এ জন্য ছয় বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। অথচ সরকারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুযায়ী টানা ৬০ দিন কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকলেই চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার কথা। তারপরও তিনি চাকরিতে কীভাবে পুনর্বাহল হয়েছিলেন, সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন।চট্টগ্রাম জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিনের বিএনপির সঙ্গে সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় পোস্টিং দেওয়ার জন্য তার নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু বিএনপি-সংশ্নিষ্টতার কারণে তাকে ঢাকায় পোস্টিং দেওয়া হয়নি।রংপুর জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো- চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একটি ভবন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় নিম্নমানের কাজ করেন। এ ঘটনায় আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা হয় দুদকে। নিম্নমানের কাজের কারণে সেটা এখনও বুঝে নেয়নি ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ।এ ছাড়া আশরাফুল আলম ঢাকা-চট্টগ্রামের পরিত্যক্ত ভবন টেন্ডার কমিটির সদস্য সচিব থাকার কারণেও তার বিরুদ্ধে ওই সময় ব্যাপক কমিশন-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। এদের মধ্যে প্রায় সবাই জি কে শামীমকে ঠিকাদারি কাজ দিয়েছেন।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2019 bhabisyatbangladesh
Developed by: A TO Z IT HOST
Tuhin