মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০২:২৫ অপরাহ্ন

লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার উত্থান যেভাবে

Reporter Name
  • Update Time : শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
  • ১২৯৭ Time View

১৯৯৪ থেকে ২০১৯। এই ২৫ বছর ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। দীর্ঘ ১৭ বছর সাধারণ সম্পাদক এবং আট বছর ডাইরেক্টর ইনচার্জের পদ দখল করে রীতিমতো ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে গেছেন তিনি।

খেলাধুলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর হাত ধরে মোহামেডান ক্লাবে প্রবেশ লোকমানের। এরপর থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক এই ক্যাডারের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিএনপির শাসন আমলে শুধু ক্রীড়াঙ্গনেই নয়, টেন্ডার বাণিজ্যেও জড়িয়ে পড়েন। মতিঝিলের সিটি সেন্টার, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টেন্ডার কাজে নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন লোকমান ভূঁইয়া।

বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনে টাকার বিনিময়ে কাউন্সিলরশিপ ও পদ বিক্রি করতেন। বিশেষ করে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির কাউন্সিলরশিপ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন লোকমান ভূঁইয়া। সারাজীবন ফুটবল সংগঠক হিসেবে খ্যাত লোকমান ভূঁইয়া ২০১৩ সালে ক্রিকেট বোর্ডে ঢুকে পড়েন। বিসিবির কর্মকর্তা হয়েই একের পর এক ব্যবসা-বাণিজ্য বাগিয়ে নেন লোকমান ভূঁইয়া।

শুধু তাই নয়, নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের ক্লাবের পরিচালনা পর্ষদে নিয়ে আসেন লোকমান। বাদল রায়, সালাম মুর্শেদীর মতো খেলোয়াড়দের জায়গা হয়নি এই পর্ষদে। ক্লাবের ক্ষমতা দখলে নেয়ার পর খেলা রেখে টাকার দিকে ঝুঁকে পড়েন এই পরিচালক। নিজের ইচ্ছামতো ক্লাবকে ব্যবহার করে টাকার পাহাড় বানিয়েছেন বলে অভিযোগ সাবেক পরিচালক বাদল রায়ের।

ক্যাসিনো চালু করে বিদেশে কোটি কোটি টাকার পাহাড় জমিয়েছেন লোকমান ভূঁইয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের আগে, লাল-নীল আলোয় ঝলমল করত পুরো ক্লাব অঙ্গন। নানা ধর্ম ও মনের মানুষের আনাগোনা এবং বিলাসবহুল গাড়ির ভিড়ে রাতদিন মুখরিত থাকত ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।

বর্তমানে তা সবই উবে গেছে। নেই কোলাহল। নেই লোকজন। ’৭০ ও ’৮০ দশকে এই ক্লাবে হাজারও মানুষের ভিড় লেগে থাকত তারকা খেলোয়াড়দের একনজর দেখার টানে। আর এখন মানুষ আসে ক্যাসিনোর টানে, জুয়ার প্রলোভনে। ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক মোহামেডানের কপালে জুয়ার কলঙ্ক লেপ্টে দিয়েছে বর্তমান নেতৃত্ব।

ক্যাসিনো থেকে প্রতি রাতে ক্লাবের তহবিলে জমা হতো মাত্র ৭০ হাজার টাকা। অথচ আরও পাঁচ লাখ টাকা পকেটে পুরতেন কর্মকর্তারা। এর মধ্যে চার লাখ টাকা নিতেন মেম্বার ইনচার্জ লোকমান ভূঁইয়া। বর্তমান কমিটির কয়েকজন পেতেন নিয়মিত মাসোহারা। শুধু তাই নয়, ক্লাবে ছিল সাতটি জুয়ার বোর্ড। রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই চলত জুয়া খেলা। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, রাজনৈতিক নেতাসহ সমাজের নানাস্তরের লোকজন জুয়া খেলায় মত্ত থাকত। ওইসব জুয়ার বোর্ড থেকেও নির্দিষ্ট অঙ্কের ভাড়া যেত ক্লাব তহবিলে।

তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন পরিচালনা বোর্ডের কয়েকজন সদস্য। অথচ এই ক্লাবটির গঠনই হয়েছিল, মুসলিম জাগরণের স্মারক হিসেবে। ইংরেজদের শাসন আমলে অবিভক্ত ভারতে মুসলমানদের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না।

তদুপরি বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা ছিল নাজুক। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া কোনো বিষয়েই তাদের গর্ব করার মতো কিছু ছিল না। সেই অন্ধকার যুগে বাঙালি মুসলমানদের প্রাণের স্পন্দনে পরিণত হয়েছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, আব্বাস উদ্দিনের গান এবং মোহামেডান ফুটবল দল। ১৮৯১ সালে হামিদিয়া ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৩৪ সালে মোহামেডান কলকাতা ফুটবল লিগের দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে খেলার সুযোগ পায়। তারপর টানা পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি করে।

১৯৩৪ সালে পূর্ববঙ্গে যাত্রা শুরু হয় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের। ১৯৫৭, ১৯৫৯, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭৫, ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮০, ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮-৮৯, ১৯৯৩, ১৯৯৬, ১৯৯৯ এবং ২০০২ সালে ঢাকা লিগের শিরোপা ঘরে তুলে আনে ক্লাবটি।

ষাটের দশক থেকে শুরু করে সত্তর ও আশির দশকে দেশের ফুটবলে চলতে থাকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের দাপট। সেই দাপট আর নেই এই দলটির। ২০০২ সালে সর্বশেষ ঢাকা লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারা। বছরের পর বছর লুটপাট ও কুক্ষিগত করে রাখার কারণে ক্লাবমুখো হন না ত্যাগী ও পুরনো ক্রীড়া সংগঠকরা।

এখানে খেলার চেয়ে ব্যবসা চলে বেশি। ক্লাবকে ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন অনেকেই। ‘মোহামেডান ক্লাবের ঐতিহ্য ও ইতিহাস আজ ভূলুণ্ঠিত হওয়ার উপক্রম। দেশের কোটি কোটি সমর্থকের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক মোহামেডানকে ঘিরে চলছে অশুভ তৎপরতা’, কথাগুলো বলেছিলেন মোহামেডানের আজীবন সদস্য ও বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক মনিরুল হক চৌধুরী।

তিনি যোগ করেন, ‘এ দেশে মোহামেডান ক্লাবের জন্ম হয়েছিল একটি বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। যুগ যুগ ধরে ক্লাবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন সময় ত্যাগী ক্রীড়া সংগঠকরা এই ক্লাবের হাল ধরেছেন। মইনুল ইসলাম, কর্নেল মালেক ও শফিকুল গনি স্বপনদের অবদান আজ স্বীকার করা হয় না। ওনাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো মিলাদ হয় না ক্লাবে।’ মোহামেডানের এই প্রাণপুরুষ বলেন, ‘সরকার এই ক্লাবের সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি দিয়েছে ক্রীড়া সামাজিক ও সাংস্কৃতির কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। অথচ সেই ক্লাবটিকে বিক্রি করে ফায়দা লুটছে লোকমান হোসেন ভূঁইয়া।

২০০১ সালে জাতীয় সংসদ থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি টেনেহিঁচড়ে নামানোর নেতৃত্ব দেয়া লোকমান আজ মোহামেডানের সর্বেসর্বা। কখনও বিএনপি, কখনও আওয়ামী লীগের লেবাস লাগিয়ে ক্লাব লুটেপুটে খাচ্ছে এই চক্রটি।’

ক্লাবের অন্তপ্রাণ সাবেক ফুটবলার বাদল রায়ের কথা, ‘আমার কষ্ট হয়, দুঃখ হয়- আমার প্রিয় মোহামেডান ক্লাব আজ ক্যাসিনো জুয়ার মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। নামে স্পোর্টিং ক্লাব হলেও এখানে কোনো ময়দানি খেলা নেই। এটা মোহামেডানের কোটি সমর্থকের জন্য অত্যন্ত বেদনার। আমার প্রত্যাশা থাকবে, ক্যাসিনো-জুয়ামুক্ত করে মোহামেডানকে সৎ, দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তার হাতে তুলে দেয়া হোক।’ গ্রেফতারের আগে এসব অভিযোগ সম্পর্কে ক্লাবের মেম্বার ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া বুধবার রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে যুগান্তরকে বলেন, ‘মোহামেডান ক্লাবকে বিএনপি ঘরানার বলেই মনে করা হয়। কিন্তু বিএনপির কোনো লোকজন এখানে আসেন না।

সহযোগিতাও করেন না। এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে ২০১১ সালে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম সাহেবকে সভাপতি করি। প্রথম দু’বছর টাকা দিলেও গত তিন বছর ধরে তার সঙ্গে টেলিফোনেও যোগাযোগ হয়নি আমাদের। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ভালো মানের দল গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না।

সব ক্লাবে যখন ক্যাসিনো বসানো হয়েছে, তখন মোহামেডান ক্লাবেও আমাদের বাধ্য হয়ে সম্মতি দিতে হয়েছে। যদিও আমি সম্মতি না দেয়ার পক্ষে ছিলাম। এজন্য দিন পনেরো পালিয়েছিলাম। ক্লাবের প্রতিদিন বাজার খরচ নিদেনপক্ষে ৩০ হাজার টাকা। তার মধ্যে কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল ও আনুষঙ্গিক খরচসহ মাসে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন। এই অর্থ জোগাড় করতে আমাদের মানুষের কাছে ধারদেনা করতে হয়েছে।’

লোকমান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, ক্লাবে একজন নতুন সভাপতি নির্বাচিত করার জন্য। বছরে দশ, বারো কোটি টাকা খরচ হয়। এই অর্থ জোগাড় করতে না পারলে মোহামেডান ক্লাব মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। ক্লাবের অনেক শুভাকাক্সক্ষী রয়েছেন। কিন্তু দৃশ্যমান কিছু দেখা যাচ্ছে না বলে তারা আসছেন না। আমার বিশ্বাস, বর্তমানে ক্যাসিনোঝড় ক্রীড়াঙ্গনকে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সরকারের উচিত এই অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে ক্রীড়া ক্লাবগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। যাতে সমাজ থেকে এসব জুয়া ও মাদক দূর হয়ে যায়।’ সূত্র-যুগান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2019 bhabisyatbangladesh
Developed by: A TO Z IT HOST
Tuhin