রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১০:১৯ পূর্বাহ্ন

তুরস্ককে চারদিকে ঘিরে ফেলছে ফ্রান্স?

Reporter Name
  • Update Time : শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০
  • ২৪৪ Time View

প্রতিদিনই বাড়ছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় উত্তেজনা। যদিও কিছুদিন আগে এই পরিস্থিতি শান্ত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে লিবিয়া ইস্যুতে তুরস্কের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে লিবিয়ার বিতর্কিত সমুদ্রসীমা সির্তা-জুফরা অঞ্চলে উত্তেজনা কিছুটা কমেছিল।

তবে লেবাননে বিস্ফোরণ ও গ্রিসের উপকূলে তুরস্কের নতুন করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সের পদক্ষেপের ফলে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সমস্যা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ছে। গত বছরের লিবিয়ার সঙ্গে তুরস্কের করা চুক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে গত সপ্তাহে (৬ আগস্ট) গ্রিস

ও মিশর এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জুন (ইইজেড) নামে একটি নতুন চুক্তি করে। ওই চুক্তি অনুযায়ী লিবিয়ার সিরতে-জুফরা‘র (লিবিয়ার দুটি জেলা) সমুদ্রসীমায় খনিজ সম্পদ সংরক্ষণ এবং কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে ন্যস্ত করবে গ্রিস-মিশর। অন্যদিকে এটি মিশরের জলসীমার বাইরের

অঞ্চল হওয়ায় এই চুক্তি অকার্যকর। এমন পরিস্থিতিতে ওই অঞ্চলে একটি জাহাজ পাঠিয়ে তেল গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করেছে তুরস্ক। তাদের এই তৎপরতা রুখতে একপাঁয়ে খাড়া ফ্রান্স, গ্রিস, মিশর। লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের তুরস্কের সঙ্গে করা এই চুক্তি মানছে না,

দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী সৌদি মার্কিন সমর্থিত হাফতার বাহিনী। এতে পরিস্থিতি চরমভাবে উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে।চুক্তির বিষয়ে গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোস ডেনডিয়াস বলেছেন, ‘আমার বলতে কোনো সংকোচ নেই যে ইইজেড চুক্তি এই অঞ্চলে তুরস্ককে রুখতেই করা হয়েছে।’

অন্যদিকে গ্রিস ও মিশরের করা এই চুক্তি লিবিয়া ও তুরস্কের অধিকার ক্ষুন্ন করে। কারণ গ্রিস ও মিশরের মধ্যে সরাসরি কোনো জলসীমা না থাকায় দেশ দু’টির করা এই চুক্তি (ইইজেড) কার্যকরিতা পাবে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও এটি কোনো রূপ কার্যকরিতা পাবে না।

তবে এটা স্বাভাবিক যে তুরস্ক তাদের স্বার্স্থ রয়েছে এমন এলাকায় কাউকে কোনো রকমক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেবে না। একই সঙ্গে দেশটি গ্রিস উপকূলের সংখ্যালঘু সাইপ্রিটসদের অধিকার নিয়ে কাজ করা অব্যাহত রাখবে। এতে গ্রিসের দুশ্চিন্তা বাড়বে।

এই অঞ্চলে তুরস্কের নীতি হচ্ছে যুদ্ধ নয়,আলোচনার ভিত্তিতেই আইন মেনে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। আর এ জন্য কাউকে ছাড় দেবে না দেশটি। গ্রিস-মিশরের চুক্তির পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট অবশ্য এই সমস্যা সমাধানে আলোচনার বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন।

যেটি প্রতিপক্ষের জন্য একটি ভালো সুযোগ। যত রাগঢাকই করা হোক না কেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন সবারই জানে যে, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মর্কেল এবং ইউরোপায় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বোরেল দৃঢ়ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তুরস্ক

এবং গ্রিসের মধ্যকার সম্পর্ক স্থিতিশিল করতে। একই সঙ্গে তুরস্কের সঙ্গে ইইউ-এর সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। এখানে বড় একটি ঘটনা হচ্ছে মর্কেলের অনুরোধে তুরস্ক লিবিয়ার সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী পরিচালিত নিজেদের কার্যক্রম বন্ধের জন্য রাজি হয়েছিলেন।

একই সঙ্গে এরদোয়ান দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য পরিবেশ তৈরিতে কাজ করছিলেন। কিন্তু গ্রিস সরকারের বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে ফ্রান্সের একাত্মতা প্রকাশ মর্কেল এবং বোরেলকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকস মিটসোটাকিস ভেবেছিলেন তিনি মিশরের

সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্সের সহায়তায় এই অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারবেন। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে নিজের হাতকে শক্তিশালী করতে পারবেন। সে লক্ষে তিনি ‘কথার যুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তার খামখেয়ালিপনায় সামনে যে জটিলতা বড়ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভাবছেন ইইউ এবং ফ্রান্স তার এই তৎপরতাকে দীর্ঘমেয়াদে সমর্থন দিয়ে যাবে। তবে এটা ঠিক যে গ্রিসের সমর্থনে ওই অঞ্চলে সামরিক জাহাজ পাঠিয়েছে ফ্রান্স তবে ফ্রান্সের প্রতি তুরস্ক কড়া সতর্কতায় পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর করে দিয়েছে।

এতে ফ্রান্স কার্যত তুরস্কের সঙ্গে একটি অপ্রাসঙ্গিক প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়লো। তার এই কাণ্ডে অ্যাঙ্গেলা মর্কেল যে ইইউ-এর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সে কার্যক্রম চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে পর্দার আড়ালের দুই প্রতিপক্ষ রাশিয়া

ও তুরস্ককে লিবিয়াতেও প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তিনি লিবিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী জেনারেল হাফতার বাহিনীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। আবার আফ্রিকা অঞ্চলের এই সংঘাতে রাশিয়াকে ডেকে আনার চেষ্টা করছেন।

লিবিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী হাফতার বাহিনীর পক্ষে রাশিয়ার সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করছেন। লিবিয়ার বিতর্কিত সিরতা ও জুফরা অঞ্চলে সামরিক জাহাজ পাঠিয়ে গ্রিসকে সমর্থন দিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসকে এক ভয়াবহ সংঘাতে জড়িয়ে দেয়ার সব আয়োজনও সম্পন্ন করেছেন।

অন্যদিকে লেবাননের বৈরুত বিস্ফোরণের পর ম্যাক্রোঁ শহরটিতে গিয়ে তুরস্ককে কার্যত লেবাননের পরিস্থিতে হস্তক্ষেপের জন্য উস্কানি দিয়েছেন। এটি মূলত সিরিয়া ও ইরাকে কুর্দিদের নিয়ে সংঘাত জড়িয়ে থাকা তুরস্ককে প্রতিবেশীদের সঙ্গে চারদিক থেকে সংঘাতে জড়িয়ে দেয়ার একটি কৌশল।

এখানে লক্ষণীয় যে, বৈরুতে ম্যাক্রোঁ তার বক্তব্যে বলেন, ‘ফ্রান্স লেবাননের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে আমাদের এখানে কিছু দায়িত্ব রয়েছে। আমরা যদি আমাদের দায়িত্ব পালন না করি তবে অন্যরা সুযোগ নিতে পারে।’ এই অন্যরা বলতে প্রতিবেশ ইরান,

সৌদি আরব,তুরস্ককেই বোঝানো হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফ্রান্স যে নিলর্জের মতো লেবানন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ধ্বংসের রাজনীতি করে যাচ্ছে। লেবাননকে কাছে টানতে এবং বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি নিজের পক্ষে নিতে ম্যাক্রোঁ বেহায়ার মতো করা ম্যাক্রোঁর এই মন্তব্যটির জন্য তিনি দায়ী থাকবেন।

এখানে আসলে ম্যাক্রোঁ বৈরুতে লেবাননের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো কোনো বিষয় না। প্রধান সমস্যা হচ্ছে তুরস্কের সঙ্গে ইইউর সম্পর্ক অবণতি হওয়া। এটি তার প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ের ঘটনা হওয়ায় উদ্বেগ বেশি। আমি এটা ভেবে সঙ্কিত বোধ করছি যে,

ম্যাক্রোঁ এবং মর্কেল এরদোয়ারেন বিরুদ্ধে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কখনো কখনো ভালো কিছু করে মন জয়ের চেষ্টা করলেও তাদের উদ্দেশ্য দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি করা। তবে, মর্কেল অবশেষে বুঝতে পেরেছেন তাদের এই খেলা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট রেসিপ তায়্যিপ এরদোগান বুঝতে সক্ষম।

তাই তুরস্ক তাদের ফাঁদে পা দেবে না। আর এই ধরনের খেলার ফলাফল শূন্যই। এরদোয়ান মর্কেলকে বলেছিলেন আপনি যদি অন্যকাউকে (গ্রিস) বিশ্বাস করেন তাহলে আগামী ৩-৪ সপ্তাহের জন্য সব ধরনের আলোচনা (ইইউ’র সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার) বন্ধ করে দেয়া হবে।

এর পরও মর্কেল এরদোয়ানের সতর্কতাকে আমলে নেয়নি। একটা বিষয় স্পষ্ট যে, তুরস্ক যে গ্রিস ও লিবিয়া উপকূলে ত্যাল-গ্যাস অনুসন্ধ্যানে সামরিক জাহাজ পাঠিয়েছে সেটি থেকে তারা পিছু হটবে না। কারণে ফ্রান্স বা গ্রিসের হমকিকে এরদোয়ান গ্রাহ্য করার বিশেষ কোনো করণ নেই।

মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ককে কেউ কোণঠাসা করার চেষ্টা করলে এরদোয়ান কোনোভাবেই সেটি মেনে নেবে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কোনো স্বার্থ এই অঞ্চলে নেই বললেই চলে। তাই তারা ইইউ-এর ডাকে সাড়া দিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়তে রাজি নাও হতে পারে।

এতে করে ইইউ বড় ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে। তবে ইইউ এবং জার্মানির কোনোভাবেই উচিৎ হবে না গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী মিতসোতাকিস এবং ফ্রান্সের প্রেসিন্ডেন্ট ম্যাক্রোঁর আগুন নিয়ে এই খেলায় সমর্থন দেয়া। যদি এই নিষ্ঠুর খেলা সামনে অগ্রসর হতে থাকে তবে,

ইইউ’র দীর্ঘ মেয়াদে কৌশলগত স্বার্থ বিপন্ন হবে। তাই মর্কেলের উচিত সময় ক্ষেপন না করে দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া। অন্যদিকে উত্তেজনা যতই বাড়ছে ততই আলোচনার সম্ভাবনা ক্ষিণ হয়ে আসছে। আলোচনায় লম্বা বিরতি সব পক্ষের জন্যই বড় ধরনের অসুবিধা তৈরি করবে।

ক্রমেই পরাশক্তি হয়ে ওঠা তুরস্ক যতটা সামরিক শক্তিতে এগিয়ে, কৌশলেও ঠিক ততটাই এগিয়ে এক সময়ের ওসমানী খেলাফতের উত্তরসূরীরা। স্বস্ত: তুর্কি সংবাদমাধ্যম দৈনিক সাবাহ। অনুবাদ: তোফাজ্জল হোসেন। লেখক: বুরহাতেশান দুরান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, তুরস্ক।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2019 bhabisyatbangladesh
Developed by: A TO Z IT HOST
Tuhin