শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০৬ পূর্বাহ্ন

মেজর (অব:) সিনহা হত্যা: ফেঁসে যাচ্ছেন এসপি-ওসি-আইসি

Reporter Name
  • Update Time : বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০
  • ৩২১ Time View

কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান (৩৬)কে হত্যার জন্য টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস নির্দেশ দিয়েছিলেন! ওসির নির্দেশ পেয়ে শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইসি) এসআই লিয়াকত গুলি করেন।

প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে অধীনস্থ ওসি, আইসিকে রক্ষা করতে সাফাই গাইলেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন, ভিডিও, ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষি, পুলিশের টেলিফোন রেকর্ড অনুযায়ি ফেঁসে যাচ্ছেন কক্সবাজারের এসপি,

টেকনাফ থানার ওসি ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের আইসি। মেজর (অব:) সিনহা হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপটে ৭টি মন্তব্য ও ৫টি সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই)। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়,

কক্সবাজার জেলায় বিশেষ করে টেকনাফ থানায় মাদক নির্মূলের নামে পুলিশ সদস্যদের মাঝে হত্যার প্রতিযোগিতা চলমান। যা অনাকাঙ্খিত ঘটনার জম্ম দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও দিবে বলে ধারণা করা যায়। প্রসঙ্গত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির দেওয়া উপাত্ত অনুযায়ী,

২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত কক্সবাজার উপজেলায় ২১৮টি বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলায় ঘটেছে ১৪৪টি “ক্রসফায়ার” ও “বন্দুকযুদ্ধে”র ঘটনা, যেখানে মারা গেছেন ২০৪ জন ।

ডিজিএফআই এর প্রতিবেদনে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত দিনের ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে দিন টেকনাফ থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে নিজস্ব প্রাইভেট কারে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছিলেন সিনহা মো. রাশেদ খান (৩৬)। সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন সিফাত নামের আরেকজন।

মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি প্রথমে বিজিবির একটি চেকপোস্টে এসে থামে। পরিচয় পাওয়ার পর বিজিবি সদস্যরা তাদের ছেড়ে দেন। এরপর রাত ৯টার দিকে সিনহার গাড়িটি এসে পৌঁছায় দ্বিতীয় চেকপোস্ট টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে।

পুলিশের নির্দেশনা পেয়ে গাড়ি থেকে প্রথমে হাত উঁচু করে নামেন সিফাত। এরপর নিজের পরিচয় দিয়ে হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামলেন মেজর (অব.) সিনহা। কোনও রূপ জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই মেজর (অব.) সিনহার বুকে একে একে তিনটি গুলি ছোড়েন পুলিশ

ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী। মুহূর্তেই তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। সিনহার ব্যক্তিগত পিস্তল থাকলেও সেটি গাড়িতে ছিল। নিহত মেজর (অব:) সিনহার গাড়ি থেকে পুলিশ ইয়াবা, মদ ও গাঁজা উদ্ধার করার দাবি করা হলেও তা সত্য নয় বলে উল্লেখ করা হয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

ঘটনার পর পুলিশ কক্সবাজারের নীলিমা রিসোর্ট এ এসে তল্লাশী করে। সেখানে অবস্থানরত অপর দুই জনের কেবিনে দেশি-বিদেশী মদ ও গাজা পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়,

প্রত্যক্ষ সাক্ষি নির্মূল করার প্রয়াসে পুলিশ সে সময় আটককৃত সিফাতকে অস্ত্র/ মাদক উদ্ধার অভিযানের নামে হত্যা করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশের দেয়া বক্তব্য বাস্তবতার সঙ্গে কোন মিল নেই-বরং উল্টো। ৩১ জুলাই (শুক্রবার) রাত সাড়ে ১০টার দিকে হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার একজন মাঠ কর্মী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।

তখন সিনহা মো. রাশেদ খান জীবিত ছিলেন এবং নড়াছড়া করছিলেন। এ সময় ভিডিও করতে গেলে পুলিশ তার মোবাইল ফোন ও পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেন এবং আটক করে রাখেন। রাত ১০ টা ৪৫ মিনিটের দিকে একটি মিনি ট্রাক আনা হয়।

আনুমানিক রাত ১১ টারদিকে মেজর (অব:) সিনহাকে নিয়ে মিনি ট্রাকটি কক্সবাজার হাসপাতাল উদ্দেশ্য রওনা দেয়। প্রায় ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট পর হাসপাতালে পৌঁছে ট্রাকটি। ট্রাক ড্রাইভার বলেছেন ওই সময়ে মেজর সিনহার প্রাণ ছিল। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়!

সিনহার শরীরের ওপরের অংশ কর্দমাক্ত এবং বুক ও গলা গুলিবিদ্ধ ছিল। পরনে সামরিক পোশাক হাতে হাতকড়া লাগানোর দাগ ছিল। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। এদিকে ওই ঘটনায় করা মামলার এজহারে বলা হয়েছে,

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাস আগেই খবর পেয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যের পোশাক পরা এক ব্যক্তিসহ দুজন মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন। তাঁর নির্দেশেই শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে যানবাহন তল্লাশির কাজ শুরু হয়।

মৃত্যুর আগে একাধিকবার রাশেদ তাঁর পরিচয় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও দিয়েছিলেন। ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলীর পিস্তল থেকে চার রাউন্ড গুলি ছোড়ার কথা উল্লেখ আছে এজাহারে। সিনহার মৃত্যুর দায় চাপানো হয়েছে তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতের ওপর।

টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ভাষ্যানুযায়ি এজাহারটি লেখা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় সিফাতের অপরাধ পরস্পর (সিনহা ও সিফাত) যোগসাজশে সরকারি কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র দিয়ে গুলি তাক করা ও মৃত্যু ঘটানো। মামলায় বলা হয়,

ফাঁড়ির ইনচার্জ এ সময় গাড়িচালকের আসনে বসা ব্যক্তিকে গাড়ি থেকে নেমে হাত মাথার ওপর উঁচু করে ধরে দাঁড়াতে বলেন ও বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। কিছুক্ষণ তর্ক করার পর সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে কোমরের

ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত হন। মামলাটি রেকর্ড করেন এএসআই নন্দদুলাল রক্ষিত। তিনি বলেন, ‘আইসি (ইনচার্জ) স্যার (লিয়াকত আলী) নিজের ও সঙ্গীয় অফিসার ফোর্সদের জানমাল রক্ষার্থে সঙ্গে থাকা পিস্তল দিয়ে চার রাউন্ড গুলি করেন।”

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের সুরে সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, শামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেন।

এই সময়ে তল্লাশি চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন তাঁর পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করেন। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ডিজিএফআই এর ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়,

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান (৩৬)কে যখন হত্যা করা হয় তখন তার গায়ে সামরিক বাহিনীর পোশাক ছিল। প্রতিবেদনে মন্তব্যে বলা হয়, একজন সামরিক পোশাকধারী অফিসার পরিচয় প্রদানের পরও কোনরূপ বিবেচনা ব্যতীত এসআই লিয়াকত গুলি করেন।

যা সামরিক বাহিনীর প্রতি অশ্রদ্ধা ও ক্ষোভের বহি:প্রকাশ। এসআই লিকায়াত মাদকাসক্ত অবস্থায় এ ঘটনাটি ঘটাতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়।একজন ব্যক্তি হাত তুলে গাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তাকে আটক না করে সরাসরি গুলি করা আইন বহির্ভূত।

এএসইউ এর মাঠ কর্মীর পরিচয় জানার পরও তার পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়া মোটেও কাম্য নয়। যা ঘটনার সত্যতা সংরক্ষণ করতে না দেয়ার অপকৌশল। নিহত মেজর (অব:) সিনহার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়,

অবসরের পরও হাইকিং এর উদ্দেশ্যে সামরিক পোশাক পরিধান করা আইন বহির্ভূত। নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহার বাড়ি যশোরের বীর হেমায়েত সড়কে। তার বাবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এরশাদ খান।

সিনহা ৫১ বিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করেন।প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও (এসএসএফ) দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2019 bhabisyatbangladesh
Developed by: A TO Z IT HOST
Tuhin